Type Here to Get Search Results !

☆📗সুনানে ইবনে-মাজাহ☆📗☆হাদীস সংকলণ ও তার প্রচার📗☆


সাহাবায়ে কিরাম (রা) মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিটি কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন এবং তাঁর প্রতিটি কাজ ও আচরণ সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে লক্ষ্য করতেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীগণকে ইসলামের আদর্শ ও এর যাবতীয় নির্দেশ যেমন মেনে চলার হুকুম দিতেন—তেমনি তা স্মরণ রাখতে এবং অনাগত মানব সভ্যতার কাছে পৌঁছে দেয়ারও নির্দেশ দিয়েছেন। হাদীস চর্চাকারীর জন্য তিনি নিম্নোক্ত ভাষায় দোয়া করেছেন :

نَضْرَ اللهُ امْرَأَ سَمِعَ مَقَالَتِي فَحَفِظَهَا وَوَعَاهَا وَأَدَاهَا إِلَى مَنْ لَّمْ يَسْتَعْهَا

“আল্লাহ সেই ব্যক্তিকে সজীব ও আলোকোজ্জ্বল করে রাখুন—যে আমার কথা শুনে স্মৃতিতে ধরে রেখেছে, তার পূর্ণ হেফাজত করেছে এবং এমন লোকের নিকট পৌঁছে দিয়েছে, যে তা শুনতে পায়নি” (তিরমিযী, ৪র্থ খণ্ড, বাংলা অনু., হাদীস নং ২৫৯৩-৫; উমদাতুল কারী, ২খ., পৃ. ৩৫)।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবদুল কায়স গোত্রের প্রতিনিধি দলকে প্রয়োজনীয় উপদেশ দান করে বললেন: “এই কথাগুলো তোমরা পুরোপুরি স্মরণ রাখবে এবং যারা তোমাদের পিছনে রয়েছে তাদের কাছে পৌঁছে দিবে” (বুখারী)। তিনি সাহাবীগণকে সম্বোধন করে বলেন: “আজ তোমরা (আমার নিকট দীনের কথা) শুনছো, তোমাদের নিকট থেকেও (তা) শোনা হবে এবং তোমাদের নিকট থেকে যারা শুনবে, তাদের থেকেও (তা) শোনা হবে” (মুসতাদরাক হাকেম, ১ খ., পৃ. ৯৫)। তিনি আরো বলেন: “আমার পরে লোকেরা তোমাদের নিকট হাদীস শুনতে চাইবে। তারা এই উদ্দেশে তোমাদের নিকট এলে তাদের প্রতি সদয় হও এবং তাদের নিকট হাদীস বর্ণনা করো (মুসনাদ আহমাদ)। তিনি অন্যত্র বলেছেন: “আমার নিকট থেকে একটি বাক্য হলেও তা অন্যের কাছে পৌঁছে দাও” (বুখারী)। ৮ম হিজরীতে মক্কা বিজয়ের পরের দিন এবং ১০ম হিজরীতে বিদায় হজ্জের ভাষণে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ “উপস্থিত লোকেরা যেন অনুপস্থিতদের নিকট আমার এ কথাগুলো পৌঁছে দেয়” (বুখারী)।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উল্লেখিত বাণীর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে তাঁর সাহাবীগণ হাদীস সংরক্ষণে উদ্যোগী হন। প্রধানত তিনটি শক্তিশালী সূত্রের মাধ্যমে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস সংরক্ষিত হয়ঃ (১) উম্মাতের নিয়মিত আমল, (২) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের লিখিত ফরমান, সাহাবীদের নিকট লিখিত আকারে সংরক্ষিত হাদীস ও পুস্তিকা এবং (৩) হাদীস মুখস্ত করে স্মৃতির ভাণ্ডারে সঞ্চিত রাখা, অতঃপর বর্ণনা ও অধ্যাপনার মাধ্যমে লোক পরম্পরায় তার প্রচার ।

তদানিন্তন আরবদের স্মরণশক্তি ছিল অসাধারণভাবে প্রখর। কোন কিছু স্মৃতিতে ধরে রাখার জন্য একবার শ্রবণই তাদের জন্য যথেষ্ট ছিল। স্মরণশক্তির সাহায্যে আরববাসীরা হাজার বছর ধরে তাদের জাতীয় ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করে আসছিল। হাদীস সংরক্ষণের ক্ষেত্রে প্রাথমিক উপায় হিসাবে এই মাধ্যমটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখনই কোন কথা বলতেন, উপস্থিত সাহাবীগণ পূর্ণ আগ্রহ ও আন্তরিকতা সহকারে তা শুনতেন, অতঃপর মুখস্ত করে নিতেন। তদানিন্তন মুসলিম সমাজে প্রায় এক লাখ লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী ও কাজের বিবরণ সংরক্ষণ করেছেন এবং স্মৃতিপটে ধরে রেখেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, “আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস মুখস্ত করতাম। এভাবেই তাঁর নিকট থেকে হাদীস মুখস্ত করা হতো” (সহীহ মুসলিম, ভূমিকা, পৃ. ১০)।

উম্মাতের নিরবচ্ছিন্ন আমল, পারস্পরিক পর্যালোচনা, শিক্ষাদান ও অধ্যাপনার মাধ্যমেও হাদীস সংরক্ষিত হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে নির্দেশ‍ই দিতেন, সাহাবীগণ সাথে সাথে তা কার্যে পরিণত করতেন। তারা মসজিদে অথবা কোন নির্দিষ্ট স্থানে একত্র হতেন এবং হাদীস আলোচনা করতেন। আনাস ইবনে মালেক (রা) বলেন, “আমরা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট হাদীস শুনতাম। তিনি যখন মজলিস থেকে উঠে চলে যেতেন, আমরা শ্রুত হাদীসগুলো পরস্পর পুনরাবৃত্তি ও পর্যালোচনা করতাম। আমাদের এক একজন করে সব কয়টি হাদীস মুখস্থ শুনিয়ে দিত। এ ধরনের প্রায় বৈঠকেই অন্তত ষাট-সত্তরজন লোক উপস্থিত থাকতো। বৈঠক থেকে আমরা যখন উঠে যেতাম, তখন আমাদের প্রত্যেকেরই সবকিছু মুখস্থ হয়ে যেতো” (আল-মাজমাউয যাওয়াইদ, ১ খ, পৃ. ১৬১)।

“আবু হুরায়রা (রা) বলেন, আমি রাতকে তিন অংশে ভাগ করে নেই। এক অংশে ঘুমাই, এক অংশে ইবাদত করি এবং এক অংশে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস অধ্যয়ন করি” (দারিমী)। মসজিদে নববীকে কেন্দ্র করে স্বয়ং মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায় যে শিক্ষায়তন গড়ে উঠেছিল, সেখানে একদল বিশিষ্ট সাহাবী (আহলুস সুফ্ফা) সার্বক্ষণিকভাবে কুরআন-হাদীস শিক্ষায় রত থাকতেন।

হাদীস সংরক্ষণের জন্য যথাসময়ে যথেষ্ট পরিমাণে লেখনী শক্তিরও সাহায্য নেয়া হয় । প্রাথমিক পর্যায়ে কুরআন মজীদ ব্যতীত সাধারণত অন্য কিছু লিখে রাখা হতো না।

পরবর্তী কালে হাদীসের বিরাট সম্পদ লিপিবদ্ধ হতে থাকে। “হাদীস মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায় লিপিবদ্ধ হয়নি, বরং তাঁর ইন্তিকালের শতাব্দী কাল পর লিপিবদ্ধ হয়েছে” বলে যে ভুল ধারণা বা অপপ্রচার প্রচলিত আছে তার আদৌ কোন ভিত্তি নাই। অবশ্য একথা ঠিক যে, কুরআনের সঙ্গে হাদীস মিশ্রিত হয়ে মারাত্মক পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে, কেবল এই আশংকায় ইসলামী দাওয়াতের প্রাথমিক পর্যায়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন :

لا تَكْتُبُوا عَنِّى وَمَنْ كَتَبَ عَنِّى غَيْرَ الْقُرْآن فَلْيُمْحَهُ .

“তোমরা আমার কোন কথাই লিখো না।

কুরআন ব্যতীত আমার নিকট থেকে কেউ অন্য কিছু লিখে থাকলে, তা যেন মুছে ফেলে” (মুসলিম)।

কিন্তু যেখানে এরূপ বিভ্রান্তির আশংকা ছিলো না, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে সকল ক্ষেত্রে হাদীস লিপিবদ্ধ করে রাখতে বিশেষভাবে উৎসাহিত করেন । আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট উপস্থিত হয়ে বলেন, “হে আল্লাহ্র রাসূল! আমি হাদীস বর্ণনা করতে চাই। তাই আমি স্মরণশক্তির ব্যবহারের সাথে সাথে লেখনীরও সাহায্য গ্রহণ করতে ইচ্ছুক, যদি আপনি অনুমতি দেন। তিনি বলেন: আমার হাদীস কণ্ঠস্থ করার সাথে সাথে লিখেও রাখতে পারো” (দারিমী) ।

আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা) আরও বলেন, “আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট যা কিছু শুনতাত, মনে রাখার জন্য তা লিখে নিতাম। কতক সাহাবী আমাকে তা লিখে রাখতে নিষেধ করলেন এবং বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজন মানুষ, কখনও স্বাভাবিক অবস্থায় আবার কখনও রাগান্বিত অবস্থা কথা বলেন। এ কথা বলার পর আমি হাদীস লেখা পরিত্যাগ করলাম, অতঃপর তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জানালাম। তিনি নিজ হাতের আংগুলের সাহায্যে স্বীয় মুখের দিকে ইংগিত করে বলেন :

اكْتُبْ فَوَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ مَا يَخْرُجُ مِنْهُ الاَ الْحَقُّ .

“তুমি লিখে রাখো। সেই সত্তার শপথ, যাঁর হাতে আমার প্রাণ! এই মুখ দিয়ে সত্য ছাড়া অন্য কিছু বের হয় না” (আবু দাউদ, মুসনাদ আহমাদ, দারিমী, হাকেম, বায়হাকী)।

তাঁর সংকলনের নাম ছিল 'সহীফায়ে সাদিকা'। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, “সাদিকা হাদীসের একটি সংকলন, যা আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট শুনেছি” (উলূমুল হাদীস, পৃ. ৪৫)। এই সংকলনে এক হাজার হাদীস লিপিবদ্ধ ছিল।

আবু হুরায়রা (রা) বলেন, এক আনসারী সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আরজ করলেন, হে আল্লাহ্র রাসূল! আপনি যা কিছু বলেন, আমার কাছে খুবই ভালো লাগে, কিন্তু মনে রাখতে পারি না। মহানবী (স) বললেন :

استعن بيمينك وأومأ بيده إلى الْخَطِ

“তুমি ডান হাতের সাহায্য নাও। অতঃপর তিনি হাতের ইশারায় লিখে রাখার প্রতি ইঙ্গিত করলেন” (তিরমিযী)।

আবু হুরায়রা (রা) আরো বলেন, মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভাষণ দিলেন। আবু শাহ ইয়ামানী (রা) আরজ করলেন, হে আল্লাহ্র রাসূল! এ ভাষণ আমাকে লিখিয়ে দিন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভাষণটি তাকে লিখে দেয়ার নির্দেশ দেন (বুখারী, তিরমিযী, মুসনাদে আহমাদ)।

হাসান ইবনে মুনাব্বিহ (র) বলেন, আবু হুরায়রা (রা) আমাকে বিপুল সংখ্যক কিতাব (পাণ্ডুলিপি) দেখালেন। তাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস লিপিবদ্ধ ছিল” (ফাতহুল বারী)। আবু হুরায়রা (রা)-র সংকলনের একটি কপি (ইমাম ইবনে তাইমিয়ার হস্তলিখিত) দামেশক এবং বার্লিনের লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত আছে ৷

আনাস ইবনে মালেক (রা) তার (স্বহস্ত লিখিত) সংকলন বের করে ছাত্রদের দেখিয়ে বলেন, আমি এসব হাদীস মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট শুনে তা লিখে নিয়েছি, অতঃপর তাঁকে তা পড়ে শুনিয়েছি (মুসতাদরাক হাকেম, ৩ খ., পৃ. ৫৭৩)।

রাফে ইবনে খাদীজ (রা)-কে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীস লিখে রাখার অনুমতি দেন। তিনি প্রচুর সংখ্যক হাদীস লিখে রাখেন (মুসনাদে আহমাদ)।

আলী ইবনে আবু তালিব (রা)-ও হাদীস লিখে রাখতেন। চামড়ার থলের মধ্যে রক্ষিত সংকলনটি তার সাথেই থাকতো। তিনি বলতেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট থেকে এই সহীফা ও কুরআন মজীদ ব্যতীত আর কিছু লিখিনি। সংকলনটি স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লেখিয়েছিলেন। এতে যাকাত, রক্তপণ (দিয়াত), বন্দীমুক্তি, মদীনার হেরেম এবং আরও অনেক বিষয় সম্পর্কিত বিধান উল্লেখ ছিল (বুখারী, ফাতহুল বারী)। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা)-র পুত্র আবদুর রহমান (র) একটি পাণ্ডুলিপি নিয়ে এসে শপথ করে বলেন, এটা ইবনে মাসউদ (রা)-র স্বহস্ত লিখিত (জামি বায়ানিল ইল্‌ম, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৭)।

স্বয়ং মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজরত করে মদীনায় পৌঁছে বিভিন্ন জাতির সমন্বয়ে যে চুক্তিপত্র সম্পাদন করেন (মদীনার সনদ নামে প্রসিদ্ধ), হুদায়বিয়ার প্রান্তরে মক্কার মুশরিকদের সাথে যে সন্ধি করেন, বিভিন্ন সময়ে যে ফরমান জারী করেন, বিভিন্ন গোত্র প্রধান ও রাজন্যবর্গকে ইসলামের যে দাওয়াতনামা প্রেরণ করেন এবং বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোত্রকে যেসব জমি, খনি ও কূপ দান করেন, তা সবই লিপিবদ্ধ আকারে ছিল এবং তা সবই হাদীসরূপে গণ্য ।

এসব ঘটনা থেকে পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত হয় যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সময় থেকেই হাদীস লেখার কাজ শুরু হয়। তাঁর দরবারে বহু সংখ্যক লেখক সাহাবী সব সময় উপস্থিত থাকতেন এবং তাঁর মুখে যে কথাই শুনতে পেতেন, তা লিখে নিতেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায়ই অনেক সাহাবীর নিকট স্বহস্ত লিখিত সংকলন বিদ্যমান ছিল। উদাহরণস্বরূপ আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা)-র সহীফায়ে সাদিকা, আবু হুরায়রা (রা)-র সহীফায়ে সাহীহা, সহীফায়ে আলী (রা), সহীফায়ে সাদ ইবনে উবাদা (রা), মাকতূবাতে নাফে (আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা)-র সংকলন) সমধিক প্রসিদ্ধ ।

সাহাবীগণ যেভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট থেকে হাদীসের জ্ঞান লাভ করেন, তেমনিভাবে হাজার হাজার তাবিঈ সাহাবীগণের নিকট হাদীসের শিক্ষা লাভ করেন। একমাত্র আবু হুরায়রা (রা)-র নিকট আট শত তাবিঈ হাদীস শিক্ষা করেন। সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যাব, উরওয়া ইবনুয যুবাইর, ইমাম যুহরী, হাসান বসরী, ইবনে সীরীন, নাফে, ইমাম যয়নুল আবিদীন, মুজাহিদ, কাযী শুরাইহ, মাসরূক, মাকহূল, ইকরিমা, আতা, কাতাদা, ইমাম শাবী, আলকামা, ইবরাহীম নাখঈ প্রমুখ প্রবীণ তাবিঈগণের প্রায় সকলে ১০ম হিজরীর পর জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৪৮ হিজরীর মধ্যে ইস্তিকাল করেন। অন্যদিকে সাহাবীগণ ১১০ হিজরীর মধ্যে ইন্তিকাল করেন। এদিক থেকে বিচার করলে দেখা যায়, তাবিঈগণ সাহাবীগণের দীর্ঘ সাহচর্য লাভ করেন। এক একজন তাবিঈ বহু সংখ্যক সাহাবীর সাথে সাক্ষাত করে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনের ঘটনাবলী, তাঁর বাণী, কাজ ও সিদ্ধান্তসমূহ সংগ্রহ করেন এবং তা তাদের পরবর্তীগণ অর্থাৎ তাবে তাবিঈনের নিকট পৌঁছে দেন ।

হিজরী দ্বিতীয় শতকের শুরু থেকে কনিষ্ঠ তাবিঈন ও তাবে তাবিঈনের এক বিরাট দল সাহাবা ও প্রবীণ তাবিঈনের লিখিত হাদীসগুলো ব্যাপকভাবে একত্র করতে থাকেন । তারা গোটা মুসলিম জাহানে ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র উম্মাতের মধ্যে হাদীসের জ্ঞান পরিব্যাপ্ত করে দেন। এ সময় ইসলামী বিশ্বের খলীফা উমার ইবনে আবদুল আযীয (র) দেশের বিভিন্ন এলাকার প্রশাসকদের নিকট হাদীস সংগ্রহ করার জন্য রাজকীয় ফরমান প্রেরণ করেন। ফলে সরকারী উদ্যোগে সংগৃহীত হাদীসের বিভিন্ন সংকলন রাজধানী দামিশকে পৌঁছতে থাকে ! খলীফা সেগুলোর একাধিক পাণ্ডুলিপি তৈরি করিয়ে দেশের সর্বত্র পাঠিয়ে দেন। । কালে ইমাম আবু হানীফা (র)-এর নেতৃত্বে কুফায় এবং ইমাম মালেক (র)-এর নেতৃত্বে মদীনায় হাদীস ও ইসলামী আইন চর্চার বিরাট কেন্দ্র গড়ে উঠে। ইমাম মালেক (র) তার মুওয়াত্তা গ্রন্থ এবং ইমাম আবু হানীফার দুই সহচর ইমাম মুহাম্মাদ ও আবু ইউসুফ (র) ইমাম আবু হানীফার রিওয়াতগুলো একত্র করে 'কিতাবুল আছার' সংকলন করেন। এ যুগের আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য হাদীস সংকলন হচ্ছে : জামে সুফিয়ান সাওরী, জামে ইবনুল মুবারক, জামে ইমাম আওযাঈ, জামে ইবনে জুরাইজ ইত্যাদি।

হিজরী দ্বিতীয় শতকের শেষার্ধ থেকে চতুর্থ শতকের শেষ পর্যন্ত হাদীসের চর্চা আরও ব্যাপকতর হয়। এ সময়কালেই হাদীসের প্রসিদ্ধ ইমামগণ যথা ইমাম বুখারী, মুসলিম, আবু ঈসা তিরমিযী, আবু দাউদ সিজিস্তানী, নাসাঈ ও ইবনে মাজা (র)-র আবির্ভাব হয় এবং তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও দীর্ঘ অধ্যবসায়ের ফলে সর্বাধিক সহীহ ছয়খানি হাদীস গ্রন্থ (সিহাহ সিত্তা) সংকলিত হয়। এ যুগেই ইমাম শাফিঈ তার কিতাবুল উম্ম ও ইমাম আহমাদ তার আল-মুসনাদ গ্রন্থ সংকলন করেন। হিজরী চতুর্থ শতকে মুসতাদরাক হাকেম, সুনানু দারি কুতনী, সহীহ ইবনে হিব্বান, সহীহ ইবনে খুযায়মা, তাবারানীর আল-মুজাম, নুসান্নাফাত তাহাবী এবং আরও কতিপয় হাদীস গ্রন্থ সংকলিত হয়। ইমাম বায়হাকীর সুনানুল কুবরা ৫ম হিজরী শতকে সংকলিত হয় ।

চতুর্থ শতকের পর থেকে এই পর্যন্ত সংকলিত হাদীসের মৌলিক গ্রন্থগুলোকে কেন্দ্ৰ করে বিভিন্ন ধরনের সংকলন ও হাদীসের ভাষ্য গ্রন্থ এবং এই শাস্ত্রের শাখা-প্রশাখার উপর ব্যাপক গবেষণা ও বিভিন্ন গ্রন্থ রচিত হয়। বর্তমান কাল পর্যন্ত এই কাজ অব্যাহত রয়েছে। এসব সংকলনের মধ্যে তাজরীদুস সিহাহ ওয়াস সুনান, আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, আল-মুহাল্লা, মাসাবীহুস সুন্নাহ, নাইলুল আওতার প্রভৃতি সমধিক প্রসিদ্ধ ।

ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম বিজয়ের প্রাক্কাল (৭১২ খৃ.) থেকেই হাদীস চর্চা শুরু হয় এবং এখানে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে ইসলামী জ্ঞানচর্চাও ব্যাপকতর হয়। ইসলামের প্রচারক ও বাণীবাহকগণ উপমহাদেশের সর্বত্র ইসলামী জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র গড়ে তোলেন। খ্যাতনামা মুহাদ্দিস শায়খ শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামা (৭০০ হি.) ৭ম শতকে ঢাকার সোনারগাঁও আগমন করেন এবং এখানে কুরআন ও হাদীস চর্চার ব্যাপক ব্যবস্থা করেন। বংগদেশের রাজধানী হিসাবে এখানে অসংখ্য হাদীসবেত্তা সমবেত হন এবং ইলমে হাদীসের জ্ঞান এতদঞ্চলে ছড়িয়ে দেন। মুসলিম শাসনের শেষ পর্যায় পর্যন্ত এই ধারা অব্যাহত ছিল। বর্তমান কাল পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত রয়েছে। এভাবে যুগ ও বংশ পরম্পরায় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস ভাণ্ডার আমাদের নিকট পৌঁছেছে এবং ইনশাআল্লাহ অব্যাহতভাবে তা অনাগত মানব সভ্যতার কাছে পৌঁছতে থাকবে ।

ইমাম ইবনে মাজা (র)-এর জীবন ও কর্ম

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.