Type Here to Get Search Results !

☆📗সুনানে ইবনে-মাজাহ☆📗ইলমে হাদীসের কতিপয় পরিভাষা☆📗


সাহাবীঃ যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহচর্য লাভ করেছেন বা তাঁকে দেখেছেন ও তাঁর অন্তত একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন অথবা জীবনে একবার তাঁকে দেখেছেন এবং ঈমানের সাথে মৃত্যুবরণ করেছেন তাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবী বলে।

তাবিঈঃ যিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোন সাহাবীর নিকট হাদীস শিক্ষা করেছেন অথবা অন্ততপক্ষে তাকে দেখেছেন এবং মুসলমান হিসাবে মৃত্যুবরণ করেছেন, তাকে তাবিঈ বলে ।

মুহাদ্দিসঃ যে ব্যক্তি হাদীস চর্চা করেন এবং বহু সংখ্যক হাদীসের সনদ ও মতন সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান রাখেন, তাকে মুহাদ্দিস (محدث) বলে।

শায়খঃ  হাদীসের শিক্ষাদাতা রাবীকে শায়খ (شيخ) বলে ।

শায়খায়নঃ সাহাবীগণের মধ্যে আবু বাক্ ও উমার (রা)-কে একত্রে শায়খায়ন বলা হয়, কিন্তু হাদীস শাস্ত্রে ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম (র)-কে এবং ফিকহের পরিভাষায় ইমাম আবু হানীফা (র) ও আবু ইউসুফ (র)-কে একত্রে শায়খায়ন বলা হয়।

হাফিজঃ যিনি সনদ ও মতনের সমস্ত বৃত্তান্তসহ এক লাখ হাদীস আয়ত্ত করেছেন, তাকে হাফিজ (حافظ عليه) বলে।

হুজ্জাতঃ একইভাবে যিনি তিন লক্ষ হাদীস আয়ত্ত করেছেন তাকে হুজ্জাত (حجات) বলে।

হাকেমঃ  যিনি সমস্ত হাদীস আয়ত্ত করেছেন, তাকে হাকেম (حكيم) বলে ।

রাবীঃ  যিনি হাদীস বর্ণনা করেন তাকে রাবী (ربيع) বা বর্ণনাকারী বলে।

রিজালঃ হাদীসের রাবীসমষ্টিকে রিজাল (ريزال) বলে। যে শাস্ত্রে রাবীগণের জীবনী বর্ণনা করা হয়েছে তাকে আসমাউর রিজাল (أسمر ريزال) বলে।

রিওয়ায়াতঃ হাদীস বর্ণনা করাকে রিওয়ায়াত ( السرد) বলে। কখনও কখনও মূল হাদীসকেও রিওয়ায়াত বলা হয়। যেমন, এই কথার সমর্থনে একটি রিওয়ায়াত (হাদীস) আছে।

সনদঃ হাদীসের মূল কথাটুকু যে সূত্র পরম্পরায় গ্রন্থ সংকলনকারী পর্যন্ত পৌঁছেছে, তাকে (شهادة) বলে। এতে হাদীস বর্ণনাকারীদের নাম একের পর এক সজ্জিত থাকে। 

মতনঃ  হাদীসের মূল কথা ও তার শব্দসমষ্টিকে মতন (يحب) বলে।

মারফূঃ যে হাদীসের সনদ (বর্ণনা পরম্পরা) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছেছে অর্থাৎ যে সনদের ধারাবাহিকতা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে হাদীস গ্রন্থ সংকলনকারী পর্যন্ত সুরক্ষিত আছে এবং মাঝখান থেকে কোন রাবীর নাম বাদ পড়েনি তাকে মারফু (مارفو) হাদীস বলে।

মাওকৃষ্ণঃ যে হাদীসের বর্ণনা সূত্র উর্ধ্বদিকে সাহাবী পর্যন্ত পৌঁছেছে অর্থাৎ যে সনদ সূত্রে কোন সাহাবীর কথা বা কাজ বা অনুমোদন বর্ণিত হয়েছে, তাকে মাশুকৃষ্ণ (مشوكريشنا) হাদীস বলে । এর অপর নাম আছার (شكرًا لك)।

মাকভূঃ যে হাদীসের সনদ কোন তাবিঈ পর্যন্ত পৌঁছেছে তাকে মাকতু (ماكتو) হাদীস বলে।

তালীকঃ কোন কোন গ্রন্থকার কোন হাদীসের পূর্ণ সনদকে বাদ দিয়ে কেবল মূল হাদীসটিই বর্ণনা করেছেন। এরূপ করাকে তালীক (قائمة) বলে। কখনো কখনো তালীকরূপে বর্ণিত হাদীসকেও 'তালীক' বলে। ইমাম বুখারী (র)-এর সহীহ গ্রন্থে এরূপ বহু ‘তালীক’ রয়েছে। কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা গিয়েছে যে, বুখারীর সমস্ত তালীকেরই মুত্তাসিল সনদ রয়েছে। অপর সংকলনকারীগণ এই সমস্ত তালীক মুত্তাসিল সনদে বর্ণনা করেছেন।

মুদাল্লাসঃ যে হাদীসের রাবী নিজের প্রকৃত শায়েখ (উসতাদ)-এর নাম উল্লেখ না করে তার উপরস্থ শায়খের নামে এভাবে হাদীস বর্ণনা করেছেন যাতে মনে হয় যে, তিনি নিজেই উপরস্থ শায়খের নিকট তা শুনেছেন, অথচ তিনি তার নিকট সেই হাদীস শুনে নাই, সে হাদীসকে হাদীসে মুদাল্লাস (مدلس) বলে এবং এইরূপ করাকে 'তাদলীস' বলে । আর যিনি এইরূপ করেন তাকে মুদাল্লিস বলে। মুদাল্লিসের হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়, যে পর্যন্ত না একথা নিশ্চিতরূপে জানা যায় যে, তিনি একমাত্র সিকাহ রাবী থেকেই তাদলীস করেন অথবা তিনি আপন শায়খের নিকট শুনেছেন বলে পরিষ্কারভাবে বলে দেন ।

মুখতারাবঃ যে হাদীসের রাবী হাদীসের মতন বা সনদকে বিভিন্ন প্রকারে গোলমাল করে বর্ণনা করেছেন, সে হাদীসকে হাদীসে মুখতারাব (مخترب) বলে। যে পর্যন্ত নাএর কোনরূপ সমন্বয় সাধন সম্ভবপর হয়, সে পর্যন্ত এই সম্পর্কে তাওয়াক্কুষ্ণ (অপেক্ষা) করতে হবে (অর্থাৎ এই ধরনের রিওয়ায়াত প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না)।

মুদরাজঃ যে হাদীসের মধ্যে রাবী নিজের অথবা অপরের উক্তিকে প্রক্ষেপ করেছেন, সে হাদীসকে মুদরাজ (مدرج প্রক্ষিপ্ত) বলে এবং এইরূপ করাকে ইদরাজ (ادراج) ৱলে । ইদরাজ হারাম, অবশ্য যদি এদ্বারা কোন শব্দ বা বাক্যের অর্থ প্রকাশ করা হয় এবং একে মুদরাজ বলে সহজে বুঝা যায়, তবে তা দূষণীয় নয় ।

মুত্তাসিলঃ যে হাদীসের সনদের ধারাবাহিকতা উপর থেকে নিচ পর্যন্ত পূর্ণরূপে রক্ষিত আছে, কোন স্তরেই রাবীর নাম বাদ পড়েনি, তাকে মুত্তাসিল (موتاسيل) হাদীস বলে।

মুদালঃ যে হাদীসের সনদ থেকে পরপর দুইজন রাবীর নাম বাদ পড়েছে তাকে 'হাদীসে মুদাল' (المدال في الحديث) বলা হয়।

মুনকাতিঃ যে হাদীসের সনদের ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয়নি, মাঝখানের কোন এক স্তরে কোন রাবীর নাম বাদ পড়েছে, তাকে মুনকাতি (منكاتي) হাদীস বলে। আর এই বাদ পড়াকে বলে ইনকিতা (انكيتا)।

মুরসালঃ যে হাদীসের সনদের ইনকিতা শেষের দিকে হয়েছে অর্থাৎ সাহাবীর নাম বাদ পড়েছে এবং তাবিঈ সরাসরি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামোল্লেখ করে হাদীস বর্ণনা করেছেন, তাকে মুরসাল (مرسال له) হাদীস বলে ।

মুতাবি ও শাহিদঃ এক রাবীর হাদীসের অনুরূপ যদি অপর রাবীর কোন হাদীস পাওয়া যায় তবে দ্বিতীয় রাবীর হাদীসটিকে প্রথম রাবীর হাদীসটির মুতাবি (المطبخ) বলে, যদি উভয় হাদীসের মূল রাবী (অর্থাৎ সাহাবী) একই ব্যক্তি হন। আর এইরূপ হওয়াকে মুতাবাআত বলে। যদি মূল রাবী একই ব্যক্তি না হন তবে দ্বিতীয় ব্যক্তির হাদীসকে শাহিদ (شهيد) বলে। আর এইরূপ হওয়াকে শাহাদাত বলে। মুতাবাআত ও শাহাদাত দ্বারা প্রথম হাদীসটির শক্তি বা প্রামাণ্যতা বৃদ্ধি পায় ।

মুআল্লাকঃ সনদের ইনকিতা প্রথম দিকে হলে অর্থাৎ সাহাবীর পর এক বা একাধিক রাবীর নাম বাদ পড়লে, তাকে মুআল্লাক (معلّق) হাদীস বলে ।

মারুফ ও মুনকারঃ কোন দুর্বল রাবীর বর্ণিত হাদীস অপর কোন দুর্বল রাবীর বর্ণিত হাদীসের বিরোধী হলে, অপেক্ষাকৃত কম দুর্বল রাবীর হাদীসকে মারূফ (এই) বলে এবং অপর রাবীর হাদীসটিকে মুনকার (منكر) বলে। মুনকার হাদীস গ্রহণযোগ্য নয় ।

সহীহঃ যে মুত্তাসিল হাদীসের সনদে উল্লেখিত প্রত্যেক রাবীই পূর্ণ আদালত ও যাত গুণসম্পন্ন এবং হাদীসটি যাবতীয় দোষত্রুটিমুক্ত, তাকে সহীহ (لا عيب فيه) হাদীস বলে।

হাসানঃ যে হাদীসের কোন রাবীর যাবৃতগুণে পরিপূর্ণতার অভাব রয়েছে, তাকে হাসান (حسان) হাদীস বলে। ফিক্‌হবিদগণ সাধারণত সহীহ ও হাসান হাদীসের ভিত্তিতে আইন প্রণয়ন করেন।

যঈফঃ যে হাদীসের কোন রাবী হাসান হাদীসের রাবীর গুণসম্পন্ন নন, তাকে যঈফ (يايف) হাদীস বলে। রাবীর দুর্বলতার কারণেই হাদীসটিকে দুর্বল বলা হয়, অন্যথায় (নাউযুবিল্লা) মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোন কথাই যঈফ নয় ।

মাওদূঃ যে হাদীসের রাবী জীবনে কখনও ইচ্ছাকৃতভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামে মিথ্যা কথা রচনা করেছেন বলে প্রমাণিত হয়েছে, তার বর্ণিত হাদীসকে মাওদূদ (مودود) হাদীস বলে। এরূপ ব্যক্তির বর্ণিত হাদীস গ্রহণযোগ্য নয় ।

মাতরূকঃ যে হাদীসের রাবী হাদীসের ক্ষেত্রে নয়, বরং সাধারণ কাজেকর্মে মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করে বলে খ্যাত, তার বর্ণিত হাদীসকে মাতরূক (متروك) হাদীস বলে । এরূপ ব্যক্তির বর্ণিত হাদীসও পরিতাজ্য।

মুবহামঃ যে হাদীসের রাবীর উত্তমরূপে পরিচয় পাওয়া যায়নি, যার ভিত্তিতে তার দোষগুণ বিচার করা যেতে পারে, এরূপ রাবীর বর্ণিত হাদীসকে মুবহাম (مبهم) হাদীস বলে। এই ব্যক্তি সাহাবী না হলে তার হাদীসও গ্রহণযোগ্য নয় ।

মুতাওয়াতিরঃ যে সহীহ হাদীস প্রতিটি যুগে এত অধিক লোক রিওয়ায়াত করেছেন, যাদের পক্ষে মিথ্যার জন্য দলবদ্ধ হওয়া সাধারণত অসম্ভব, তাকে মুতাওয়াতির (المطاوي) হাদীস বলে। এই ধরনের হাদীস দ্বারা নিশ্চিত জ্ঞান (معرفة معينة) লাভ হয় ।

খবরে ওয়াহিদঃ প্রতিটি যুগে এক, দুই অথবা তিনজন রাবী কর্তৃক বর্ণিত হাদীসকে খবরে ওয়াহিদ (وحيد) বা আখবারুল আহাদ (أحد) বলে । এই হাদীস তিন প্রকারঃ

মাশহূরঃ যে সহীহ হাদীস প্রতিটি যুগে অন্ততপক্ষে তিনজন রাবী বর্ণনা করেছেন, তাকে মাশহুর (الشهير) হাদীস বলে।

আযীযঃ যে সহীহ হাদীস প্রতিটি যুগে অন্তত দুইজন রাবী বর্ণনা করেছেন তাকে আযীয ( ذو قيمة) বলে।

গরীবঃ যে সহীহ হাদীস কোন যুগে একজন মাত্র রাবী বর্ণনা করেছেন তাকে গরীব (الفقير) হাদীস বলে।

হাদীসে কুদসীঃ এ ধরনের হাদীসের মূলকথা সরাসরি আল্লাহ্র নিকট থেকে প্রাপ্ত এবং আল্লাহ্র সাথে সম্পর্কিত করে (যেমন الله نبيه)। আল্লাহ তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ইলহাম কিংবা স্বপ্নযোগে অথবা জিবরীল (আ)-এর মাধ্যমে তা জানিয়ে দিয়েছেন, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা নিজ ভাষায় বর্ণনা করেছেন। হাদীসে কুদসীকে হাদীসে ইলাহী (إلهي) বা রব্বানী (رباني)-ও বলা হয় ।

মুত্তাফাক আলায়হঃ যে হাদীস একই সাহাবী থেকে ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম উভয়ে গ্রহণ করেছেন, তাকে মুত্তাফাক আলায়হ (موفق عليا) হাদীস বলে।

আদালতঃ যে সুদৃঢ় শক্তি মানুষকে তাকওয়া ও শিষ্টাচার অবলম্বনে এবং মিথ্যা আচরণ থেকে বিরত থাকতে উদ্বুদ্ধ করে তাকে আদালত (المحكمة) বলে। এখানে তাকওয়া বলতে অশোভনীয় ও অভদ্রোচিত কার্য থেকে বিরত থাকা, যেমন হাট-বাজারে বা প্রকাশ্যে পানাহার করা বা রাস্তা-ঘাটে পেশাব-পায়খানা করা ইত্যাদি থেকে বিরত থাকা বুঝায়। এসব গুণে গুণান্বিত ব্যক্তিকে আদিল বলে।

যাবতঃ যে স্মৃতিশক্তি দ্বারা মানুষ শ্রুত বা লিখিত বিষয়কে বিস্মৃতি বা বিনাশ থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয় এবং যখন ইচ্ছা তা সঠিকভাবে স্মরণ করতে পারে তাকে যাবত (حتى) বলে।

ছিকাহঃ যে রাবীর মধ্যে আদালত ও যাবত উভয় গুণ পূর্ণভাবে বিদ্যমান তাকে ছিকাহ (الشيخة), সাবিত (ثبت) বা সাবাত (السبت) বলে।

হাদীস গ্রন্থসমূহের শ্রেণীবিভাগ: হাদীস গ্রন্থ প্রণয়নের বিভিন্ন ধরন ও পদ্ধতি রয়েছে। এসব গ্রন্থের নামও বিভিন্ন ধরনের। নিম্নে এর কতিপয় প্রসিদ্ধ পদ্ধতির নাম উল্লেখ করা হল :

১. আল-জামেঃ যেসব হাদীস গ্রন্থে আকীদা-বিশ্বাস, আহকাম (শরীআতের আদেশ-নিষেধ), আখলাক ও আদাব, দয়া, যুদ্ধ ও সন্ধি, শত্রুদের মোকাবিলায় মুজাহিদ বাহিনী প্রেরণ, বিশৃঙ্খলা-বিপর্যয়, রিকাক, প্রশংসা ও মর্যাদার বর্ণনা ইত্যাদি সকল প্রকারের হাদীস বিভিন্ন অধ্যায়ে সন্নিবেশিত হয় তাকে আল-জামি (الجامع) বলা হয়। সহীহ বুখারী ও জামে তিরমিযী এর অন্তর্ভুক্ত। সহীহ মুসলিমে যেহেতু তাফসীর ও কিরাআত সংক্রান্ত হাদীস খুবই কম তাই কোন কোন হাদীস বিশারদের মতে তা জামে শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত নয়।

২. আস-সুনানঃ যেসব হাদীস গ্রন্থে কেবলমাত্র শরীআতের হুকুম-আহকাম ও ব্যবহারিক জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় নিয়মনীতি ও আদেশ-নিষেধমূলক হাদীস একত্র করা হয় এবং ফিকহের গ্রন্থের ন্যায় বিভিন্ন অধ্যায় ও অনুচ্ছেদে সজ্জিত করা হয় তাকে সুনান (سنن) বলে। যেমন সুনান আবু দাউদ, সুনান নাসাঈ, সুনান ইবনে মাজা ইত্যাদি। তিরমিযী শরীফও এক হিসাবে সুনান গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত।

৩. আল-মুসনাদঃ যেসব হাদীস গ্রন্থে সাহাবীদের থেকে বর্ণিত হাদীসসমূহ তাঁদের নামের আদ্যাক্ষর অনুযায়ী পরপর সংকলিত হয়, ফিকহের পদ্ধতিতে সংকলিত হয় না তাকে আল-মুসনাদ ( لمسند) বা আল-মাসানীদ (المساند) বলে । যেমন হযরত আয়েশা (রা) কর্তৃক বর্ণিত সমস্ত হাদীস তার নামের শিরোনামের অধীনে একত্র করা হয়। যেমন ইমাম আহমাদ (র)-এর আল-মুসনাদ গ্রন্থ, মুসনাদে আবু দাউদ তায়ালিসী ইত্যাদি।

৪. আল-মুজামঃ যে হাদীস গ্রন্থে মুসনাদ গ্রন্থের পদ্ধতিতে এক একজন উস্তাদের নিকট থেকে প্রাপ্ত হাদীসসমূহ পর্যায়ক্রমে একত্রে সন্নিবেশিত করা হয় তাকে আল-মুজাম (المعجم) বলে। যেমন ইমাম তাবারানী সংকলিত আল-মুজামুল কাবীর ।

৫. আল-মুসতাদরাক: যেসব হাদীস বিশেষ কোন হাদীস গ্রন্থে শামিল করা হয়নি, অথচ তা সংশ্লিষ্ট গ্রন্থকারের অনুসৃত শর্তে পূর্ণমাত্রায় উত্তীর্ণ হয়, সেইসব হাদীস যে গ্রন্থে সন্নিবেশিত করা হয় তাকে আল-মুসতাদরাক (المستدرك) বলে। যেমন ইমাম হাকেম নিশাপুরীর আল-মুসতাদরাক গ্রন্থ

৬. রিসালাঃ যে ক্ষুদ্র কিতাবে মাত্র এক বিষয়ের হাদীসসমূহ একত্র করা হয়েছে তাকে রিসালা (رساله) বা জু্যু (جويو) বলে।

সিহাহ সিত্তাঃ বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, আবু দাউদ, নাসাঈ ও ইবন মাজা, এই ছয়টি গ্রন্থকে একত্রে সিহাহ সিত্তা (سيها سيتا) বলা হয়। কিন্তু কতক বিশিষ্ট আলেম ইবনে মাজার পরিবর্তে ইমাম মালেক (র)-এর মুওয়াত্তাকে, আবার কতকে সুনানুদ দারিমীকে সিহাহ সিত্তার অন্তর্ভুক্ত করেছেন ।

সাহীহায়নঃ সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমকে একত্রে সহীহায়ন (دعم معا) বলে।

সুনানে আরবাজাঃ সিহাহ সিত্তার অপর চারটি গ্রন্থ-আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাকে একত্রে সুনানে আরবাআ (سنن أربعاء) বলে।

হাদীসের কিতাবসমূহের স্তর বিভাগঃ হাদীসের কিতাবসমূহকে মোটামুটিভাবে পাঁচটি স্তর বা তাকায় ভাগ করা হয়েছে। শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিস দিহলাবী (রাঃ)-ও তাঁর হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা' নামক কিতাবে এরূপ পাঁচ স্তরে ভাগ করেছেন।

প্রথম স্তরঃ এ স্তরের কিতাবসমূহে কেবল সহীহ হাদীসই রয়েছে। এ স্তরের কিতাব মাত্র তিনটি: “মুওয়াত্তা ইমাম মালেক,” 'বুখারী শরীফ' ও 'মুসলিম শরীফ'। সকল হাদীস বিশেষজ্ঞ এ বিষয়ে একমত যে, এ তিনটি কিতাবের সমস্ত হাদীসই নিশ্চিতরূপে সহীহ।

দ্বিতীয় স্তরঃ এ স্তরের কিতাবসমূহ প্রথম স্তরের খুব কাছাকাছি। এ স্তরের কিতাবে সাধারণত সহীহ ও হাসান হাদীসই রয়েছে। যঈফ হাদীস এতে খুব কমই আছে। সুনান নাসাঈ, সুনান আবু দাউদ ও জামে আত-তিরমিযী এ স্তরেরই কিতাব। সুনান দারিমী, সুনান ইবনে মাজা এবং শাহ ওয়ালিউল্লাহ (র)-এর মতে মুসনাদ ইমাম আহমাদকেও এ স্তরে শামিল করা যেতে পারে। এই দুই স্তরের কিতাবের উপরই সকল মাযহাবের ফকীহগণ নির্ভর করে থাকেন ।

তৃতীয় স্তরঃ এ স্তরের কিতাবে সহীহ, হাসান, যঈফ, মারুফ ও মুনকার সকল রকমের হাদীসই রয়েছে। মুসনাদ আবী ইয়ালা, মুসনাদ আবদুর রাজ্জাক, বায়হাকী, তাহাবী ও তাবারানীর (র)-র কিতাবসমূহ এ স্তরেরই অন্তর্ভুক্ত ।

বিশেষজ্ঞগণের যাচাই-বাছাই ব্যতীত এ সকল কিতাবের হাদীস গ্রহণ করা যেতে পারে না।

চতুর্থ স্তরঃ এ স্তরের কিতাবসমূহে সাধারণত যঈফ ও গ্রহণের অযোগ্য হাদীসই রয়েছে। ইবনে হিব্বানের কিতাবুদ-দুআফা, ইবনুল আছীরের আল-কামিল এবং খাতীব বাগদাদী ও আবু নুআয়মের কিতাবসমূহ এই স্তরের কিতাব।

পঞ্চম স্তরঃ  উপরোক্ত স্তরে যে সকল কিতাবের স্থান নাই সে সকল কিতাবই এ স্তরের কিতাব ।

সহীহাইনের বাইরেও সহীহ হাদীস রয়েছে: বুখারী ও মুসলিম শরীফ হাদীসের সহীহ কিতাব। কিন্তু সমস্ত সহীহ হাদীসই যে বুখারী ও মুসলিমে রয়েছে তা নয়। ইমাম বুখারী (রাঃ) বলেন: 'আমি আমার এ কিতাবে সহীহ ব্যতীত কোন হাদীসকে স্থান দেই নাই এবং বহু সহীহ হাদীস আমি বাদও দিয়েছি।'

এইরূপে ইমাম মুসলিম (রাঃ) বলেন : 'আমি আমার এ কিভাবে যে সকল হাদীস সংকলন করেছি তা সমস্তই সহীহ, কিন্তু আমি এ কথা বলি না যে, এর বাইরে যে সকল হাদীস রয়েছে সেগুলি সমস্তই যঈফ।'

সুতরাং এই দুই কিতাবের বাইরেও সহীহ হাদীস ও সহীহ কিতাব রয়েছে। শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দিস দিহলাবীর মতে “সিহাহ সিত্তা”, মুওয়াত্তা ইমাম মালেক ও সুনানুদ দারিমী ব্যতীত নিম্নোক্ত কিতাবসমূহও সহীহ (যদিও বুখারী ও মুসলিমের পর্যায়ের নয়)।

১. সহীহ ইবনে খুযায়মা-আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক (৩১১ হি.) 

২. সহীহ ইবনে হিব্বান-আবু হাতিম মুহাম্মাদ ইবনে হিব্বান (৩৫৪ হি.)

৩. আল-মুস্তাদরাক হাকেম-আবু আবদুল্লাহ নিশাপুরী ( ৪০২ হি.)

৪. আল-মুখতারা-যিয়াউদ্দীন আল-মাকদিসী (৭৪৩ হি.)

৫. সহীহ আৰু আওয়ানা-ইয়াকুব ইবনে ইসহাক (৩১১ হি.)

৬. আল-মুনতাকা ইবনুল জারুদ আবদুল্লাহ ইবনে আলী ।

হাদীসের সংখ্যাঃ হাদীসের মূল কিতাবসমূহের মধ্যে ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বলের 'মুসনাদ' একটি বৃহৎ কিতাব। এতে সাত শত সাহাবী কর্তৃক বর্ণিত পুনরোল্লেখ (তাকরার)-সহ মোট ৪০ হাজার এবং 'তাকরার' বাদ ৩০ হাজার হাদীস রয়েছে। শায়খ আলী মুত্তাকী জৌনপুরীর 'মুনতাখাব কানযিল উম্মালে ৩০ হাজার এবং মূল কানযুল উম্মাল-এ (তাকরার বাদ) মোট ৩২ হাজার হাদীস রয়েছে। অথচ এই কিতাব বহু মূল কিতাবের সমষ্টি। একমাত্র হাসান ইবনে আহমাদ সমরকান্দীর 'বাহরুল আসানীদ' কিতাবেই এক লক্ষ হাদীস রয়েছে বলে বর্ণিত আছে।

মোট হাদীসের সংখ্যা সাহাবা ও তাবিঈনের আছারসহ সর্বমোট এক লক্ষের অধিক নয় বলে মনে হয়। এর মধ্যে সহীহ হাদীসের সংখ্যা আরো অনেক কম। হাকেম আবু আবদিল্লাহ নিশাপুরীর মতে প্রথম শ্রেণীর সহীহ হাদীসের সংখ্যা ১০ হাজারেও কম। সিহাহ সিত্তায় মাত্র পৌণে ছয় হাজার হাদীস রয়েছে। এর মধ্যে ২৩২৬টি হাদীস মুত্তাফাক আলায়হি। তবে যে বলা হয়ে থাকে হাদীসের বড় বড় ইমামগণের লক্ষ লক্ষ হাদীস জানা ছিল, তার অর্থ এই যে, অধিকাংশ হাদীসের বিভিন্ন সনদ রয়েছে, এমনকি শুধু নিয়াত সম্পর্কিত (بخصوص النية) হাদীসটিরই সাত শতের মত সনদ রয়েছে (তাদ্‌বীন, পৃ. ৫৪)। আমাদের মুহাদ্দিসগণ যে হাদীসের যতটি সনদ রয়েছে সেটিকে তত সংখ্যক হাদীস বলে গণ্য করেন।

হাদীস সংকলণ ও তার প্রচার

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.