আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনে ইয়াযীদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে মাজা (রাঃ) ইরানের আযারবাইজান প্রদেশের অন্তর্গত কাযবীন শহরে ২০৯ হিজরী মোতাবেক ৮২৪ খৃষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন । তিনি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীসের প্রচার ও প্রসারে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন এবং এজন্য তাকে হাদীসের সর্বশ্রেষ্ঠ ছয়জন ইমামের অন্তর্ভুক্ত গণ্য করা হয়। তিনি ছিলেন অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিত্ব এবং জ্ঞানী-গুণীদের মধ্যে জনপ্রিয়। তিনি ছিলেন একাধারে তাফসীরকার, হাদীসের হাফেজ ও ঐতিহাসিক । ইয়াকৃত আল-হামাবী মুজামুল বুলদান নামক তার ভূগোলের বিশ্বকোষে বলেন যে, ইবনে মাজা (রাঃ) কার্যবীনের সমকালীন জনপ্রিয় ইমামদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। শামসুদ্দীন যাহাবী, ইবনে হাজার আসকালানী, ইবনে খাল্লিকান প্রমুখ ইমামগণ তাকে হাদীসের ইমাম, গভীর প্রজ্ঞাবান ও উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব হিসাবে বর্ণনা করেছেন ।
তাকে কেন ইবনে মাজা বলা হয় এ বিষয়ে মতভেদ আছে। যেমন ইবনে মাজা ছিল মুহাম্মাদের বিশেষণ (সিফাত), তার দাদার নাম নয়। তবে সাধারণত বলা হয় যে, মাজা তার পিতার উপাধি। আল-কামূস গ্রন্থে বলা হয়েছে, 'মাজা' তার দাদার উপাধি। শাহ আবদুল আযীয দিহলাবী (রাঃ) নিশ্চিতভাবে বলেন যে, মাজা তার মায়ের নাম। আবুল হাসান সিন্ধী তার শরহুল আরবাঈন গ্রন্থে এবং মুরতাদা আয-যাবীদি (যুবায়দী) তার তাজুল আরূস-এ একই কথা বলেন, অর্থাৎ মাজা হলো মুহাম্মাদের মায়ের নাম। তিনি ছিলেন অনারব বংশোদ্ভূত ।
ইবনে মাজা (রাঃ)-এর বাল্যকাল ছিল ইসলামী দুনিয়ার জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতির যুগ। বালেগ হওয়ার পর তিনি হাদীসের শিক্ষালাভ ও তার সংগ্রহের জন্য আরব, ইরাক, মিসর, সিরিয়া, হিজায, মক্কা, মদীনা, খুরাসান প্রভৃতি অঞ্চল ভ্রমণ করেন। ২৩০/৮৪৪ সন থেকে তাঁর এই সফর শুরু হয়। তার ওস্তাদগণের মধ্যে যাদের নাম জানা যায় তাদের কয়েকজন হলেন : আবু বাক্ ইবনে আবু শাইবা, আবদুল্লাহ ইবনে সাঈদ আল-আশাজ্জ, মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ, আবু কুরাইব, হান্নাদ, আহমাদ ইবনে বুদাইল, তাহ্হান, বুনদার, মুহাম্মাদ ইবনুল মুসান্না, আৰু সাওর, জাওহারী, আবু ইসহাক আল-হারাবী, আবু বাক্ আস-সাগাতী, আল-আহওয়াস, আমাদ ইবনে সিনান, হিশাম ইবনে আম্মার, আবু যুরআ, আবু হাতেম আর-রাযী, আবদুর রহমান আদ-দারিমী, যুহলী ও মাহমূদ ইবনে গাইলান। তিনি তার এ সকল শিক্ষকের নিকট থেকে জ্ঞানার্জনের জন্য ইসফাহান, আওয়ায, আইলা, বালখ, বাইতুল মাকদিস, হাররান, দামিশক, ফিলিস্তীন, আসকালান, মারব ও নিশাপুরও ভ্রমণ করেন। অনুরূপভাবে তিনি বহু সংখ্যক লোককে হাদীসের শিক্ষা দান করেন। ইবনে হাজার আসকালানী তার তাহযীবুত তাহযীব গ্রন্থে এবং আল-মিযযী তার তাহযীবুল কামাল গ্রন্থে ইবনে মাজা (রাঃ)-এর ছাত্রবৃন্দের তালিকায় অনেকের নাম উল্লেখ করেছেন ।
হাদীসের মহান খেদমতের পর এ মহান মনীষী ২৭৩ হিজরীর ২০ রমযান (১৮ ফেব্রুয়ারী, ৮৮৭) কার্যবীনে ইনতিকাল করেন। তখন ছিল আব্বাসী খলীফা মুতামিদ আলাল্লাহ্র শাসনকাল। ইমাম নাসাঈ (রাঃ) ব্যতীত সিহাহ সিত্তার সকল ইমাম এই শাসকের আমলে ইনতিকাল করেন ।
ইমাম ইবনে মাজা (রাঃ)-এর অমর কীর্তি হলো তার ‘আস-সুনান' শীর্ষক সংকলন, যা সাধারণ্যে “ইবনে মাজা” নামে বহুল পরিচিত। এটি সিহাহ সিত্তা (ছয়টি সহীহ গ্রন্থ) পরিবারের ষষ্ঠ সদস্য। আবুল ফাদল মুহাম্মাদ ইবনে তাহের আল-মাকদিসী (মৃ. ৫০৭ হিজরী/১১১৩ খৃস্টাব্দ) সর্বপ্রথম এই গ্রন্থখানিকে সিহাহ সিত্তার অন্তর্ভুক্ত গণ্য করেন, তার গুরুতুল আইম্মাতিস সিত্তা গ্রন্থে সিহাহ সিত্তার শর্তাবলী পর্যালোচনার পর। পরবর্তী কালের বিশেষজ্ঞগণের মধ্যে আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতী (মৃ. ৯৯১/১৫০৫) ও আবদুল গনী আন-নাবুলুসী (মৃ. ১১৪৩/১৭৩০) একে সিহাহ সিত্তার মধ্যে গণ্য করেন। পরবর্তী কালের মুহাদ্দিসগণ সাধারণভাবে এই মত মেনে নেন। পক্ষান্তরে ইবনুস সাকান (মৃ. ৩৫৩/৯৬৪), ইবনে মানদা (মৃ. ৩৯৫/১০০৪), আবু তাহের (মৃ. ৫৭৬/১১৮০) প্রমুখ বিশেষজ্ঞ সুনান ইবনে মাজাকে সিহাহ সিত্তার মধ্যে গণ্য করার পরিবর্তে অবশিষ্ট পাঁচখানা গ্রন্থকে সিহাহ পরিবারভুক্ত মনে করেন। কেউ আবার ইবনে মাজার পরিবর্তে ইমাম মালেক (রাঃ)-এর ‘মুওয়াত্তাকে’ সিহাহ-এর অন্তর্ভুক্ত মনে করেন। আবদুল গনী আন-নাবুলুসী (রাঃ) বলেন, সিহাহ পরিবারের ষষ্ঠ গ্রন্থ সম্পর্কে মতভেদ আছে এবং পূর্বাঞ্চলীয় আলেমগণের মতে ইবনে মাজা এবং পশ্চিমাঞ্চলীয় আলেমগণের মতে মুওয়াত্তা সিহাহ-এর অন্তর্ভুক্ত। ইবনে তাহেরের সমকালীন মুহাদ্দিস আল্লামা ইবনে রাযীন (মৃ. ৫২৫/১১৩০) তার ‘তাজরীদুস সিহাহ ওয়াস-সুনান' গ্রন্থে ইবনে মাজার পরিবর্তে মুওয়াত্তাকে সিহাহ-এর অন্তর্ভুক্ত করেছেন। অনুরূপভাবে আল্লামা ইবনুল আছীর (রাঃ) (মৃ. ৬০৬/১২০৯)-ও তার 'জামিউল উসূল' গ্রন্থে একই নীতি অনুসরণ করেছেন। কেউ কেউ অবশ্য ইবনে মাজাকে মুওয়াত্তার উপরে স্থান দিয়েছেন, কিন্তু বিশুদ্ধতা ও প্রামাণিকতার দিক থেকে মুওয়াত্তা সব হাদীস গ্রন্থের ঊর্দ্ধে। সালাহুদ্দীন খলীল আল-আলাঈর (মৃ. ৭৬১/১৩৫) মতে ইবনে মাজার পরিবর্তে সুনানুদ দারিমীকে সিহাহ-এর অন্তর্ভুক্ত করা উচিৎ।
ইমাম ইবনে মাজা (রাঃ) তার সুনান গ্রন্থখানি সংকলনের পর হাফেযে হাদীস ইমাম আবু যুরআ (রাঃ)-এর সামনে পেশ করলে তিনি মন্তব্য করেন, এ গ্রন্থখানি জনগণের নিকট পৌছাতে পারলে অনেক গ্রন্থই মূল্যহীন হয়ে পড়বে। তার এই মন্তব্য বাস্তব প্রমাণিত হয়েছে। গ্রন্থখানি তার বিষয়বস্তুর কারণে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে এবং এখন বিনা মতভেদে তা সিহাহ সিত্তার অন্তর্ভুক্ত। হাদীস চয়ন এবং স্বার্থকভাবে অনুচ্ছেদ অনুযায়ী হাদীসের সামঞ্জস্যপূর্ণ বিন্যাস, ফিক্হ গ্রন্থাবলীর দৃষ্টিভংগীতে অধ্যায় ও অনুচ্ছেদ শিরোনাম নির্ধারণ ইত্যাদি গ্রন্থখানির জনপ্রিয়তার উল্লেখযোগ্য কারণ। তিনি এমন অনেক হাদীস তার সংকলনে লিপিবদ্ধ করেছেন, যা অন্য পাঁচখানি গ্রন্থে নাই। এরূপ হাদীসের সংখ্যা ১৩৩৯ এবং পাঁচ গ্রন্থে সাথে কমন হাদীস ৩০০২টি। মোট হাদীস সংখ্যা ৪,৩৪১, ইমাম যাহাবীর মতে চার হাজার। এ গ্রন্থের একই হাদীসের পুনরুক্তি একেবারেই কম এবং এটা সুনান গ্রন্থখানিকে অন্যান্য গ্রন্থ থেকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দান করেছে। আল্লামা আবুল হাসান সিন্ধীর মতে, ইমাম ইবনে মাজা (রাঃ) সাহাবী মুআয ইবনে জাবাল (রাঃ)-কে অনুসরণ করেছেন। কারণ তিনিও এমন সব হাদীস বর্ণনা করতেন যেগুলো অন্য সাহাবীগণের জানা ছিলো না। এই নীতি মেনে চলার কারণে ইবনে মাজা(রাঃ) সনদের বিশুদ্ধতার দিকে খুব কমই দৃষ্টি দিয়েছেন। তাই এ গ্রন্থখানিতে বেশ সংখ্যক যঈফ হাদীসও স্থান পেয়েছে
অন্যান্য সুনান গ্রন্থের তুলনায় এই গ্রন্থখানি সংক্ষিপ্ত হওয়া সত্ত্বেও তাতে যাবতীয় মাসআলা-মাসাইল সংক্রান্ত হাদীস বিদ্যমান আছে। এ গ্রন্থে ফযীলাত ও সাহাবীগণের মর্যাদা সম্পর্কিত হাদীসের সংখ্যা খুবই কম। কোন কোন স্থানে ইবনে মাজা (রাঃ) হাদীসের নিচে নিজের মতও ব্যক্ত করেছেন। তিনি যে হাদীসের বক্তব্য অস্পষ্ট বা অবোধগম্য হওয়ার আশংকা করেছেন সেখানে তার সাথে নিজ বক্তব্য পেশ করেছেন। যেসব হাদীস বিশেষ কোন এলাকায় প্রসিদ্ধি লাভ করেছে এবং অন্য এলাকায় অজ্ঞাত রয়ে গেছে, সেসব হাদীস বর্ণনা করার সাথে সাথে তিনি বলে দিয়েছেন যে, সংশ্লিষ্ট হাদীসটি অমুক অঞ্চলের মুহাদ্দিসগণের নিকট প্রসিদ্ধ, অন্যদের নিকট অজ্ঞাত।
একথা সত্য যে, ইবনে মাজা (রাঃ)-এর সুনান গ্রন্থে প্রায় এক হাজার যঈফ হাদীস আছে, সাথে সাথে একথাও সত্য যে, তার গ্রন্থে প্রচুর সংখ্যক সহীহ হাদীসও আছে এবং কোন কোন হাদীস ইমাম বুখারী (রাঃ)-এর সহীহ গ্রন্থে বর্ণিত হাদীসের তুলনায়ও বিশুদ্ধতর। যেমন ইমাম বুখারী (রাঃ) “ফরয নামাযের ইকামত দেয়া হলে তখন ঐ নামায ছাড়া অন্য কোন নামায পড়া যাবে না” শীর্ষক অনুচ্ছেদে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন শোবা (রাঃ)-এর সূত্রে, যার মধ্যে দু'টি ভূল আছে : ঐ গ্রন্থে সংশ্লিষ্ট হাদীসখানা ইমাম মালেকের সূত্রে বর্ণনা করা হয়েছে, অথচ তা মালেক পুত্র আবদুল্লাহর সূত্রে বর্ণিত। দ্বিতীয়ত, ঐ হাদীসের সনদে বুহাইনাকে মালেকের মাতারূপে বর্ণনা করা হয়েছে, অথচ তিনি হলেন আবদুল্লাহ্র মাতা। ইবনে মাজা (রাঃ) যে সনদে উক্ত হাদীস বর্ণনা করেছেন তাতে এই ভুল নাই। অনুরূপভাবে সহীহ বুখারীতে আছে যে, আবু সুফিয়ান (রাঃ)-এর মৃত্যুসংবাদ সিরিয়া থেকে আসে, অথচ তিনি মক্কা শরীফে ইনতিকাল করেন। ইবনে মাজার অনুরূপ রিওয়ায়াতে উক্তরূপ বক্তব্য নাই । অধিকন্তু ওলীদ ইবনে উকবা শরাব পান করলে তাকে আশি বেত্রাঘাত করা হয় বলে সহীহ বুখারীতে উল্লেখ আছে, অথচ তাকে চল্লিশ বেত্রাঘাত করা হয় । কিন্তু ইবনে মাজার বর্ণনায় বেত্রাঘাতের সংখ্যা উল্লেখ নাই ।
হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী (রাঃ) ইবনে মাজার সুনান গ্রন্থের ছয়জন রাবীর উল্লেখ করেছেন। তারা হলেন : আবুল হাসান ইবনুল কাত্তান, সুলাইমান ইবনে ইয়াযীদ, আবু জাফর মুহাম্মাদ ইবনে ঈসা, আবু বাক্ হামেদ আল-বাত্রী, সাদূন ও ইবরাহীম ইবনে দীনার (রাঃ)।
সুনান ইবনে মাজার বেশ কয়েকখানি পূর্ণাঙ্গ ও আংশিক ভাষ্যগ্রন্থ রচিত হয়েছে। যেমন শারহু সুনান ইবনে মাজা, পাঁচ খণ্ডে সমাপ্ত, অংশবিশেষের ভাষ্য। হাফেজ আলাউদ্দীন মুগালতাঈ হানাফী (মৃ. ৭৬২/১৩৬০ ); (২) বিমা তামাসা ইলাইহিল হাজাতু আলা সুনান ইবনে মাজা, শায়খ সিরাজুদ্দীন উমার ইবনে আলী (মৃ. ৮০৪ / ১৪০১), আট খণ্ডে সমাপ্ত, এই ভাষ্যখানিতে কেবল সেইসব হাদীসের ব্যাখ্যা করা হয়েছে যা অপর পাঁচটি গ্রন্থে নাই; (৩) আদ-দামীরী, আদ-দীবাজা ফী শারহি সুনান ইবনে মাজা, ৫ খণ্ড (অসমাপ্ত); (৪) জালালুদ্দীন সুয়ূতী (মৃ. ৯১১/১৫০৫), মিসবাহুজ যুজাজা; (৫) হাফেজ আবুল হাসান মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল হাদী আস-সিন্ধী (মৃ. ১১৩৮/১৭২৫), শারহু সুনান ইবনে মাজা; (৬) ফাখরুল হাসান গাঙ্গুহী, তিনি সুনান ইবনে মাজার কঠিন শব্দালীর আভিধানিক অর্থ বিশ্লেষণের প্রতি বিশেষ জোর দিয়েছেন; (৭) ফুয়াদ আবদুল বাকী, শারহু মিফতাহিস সুনান। এছাড়াও আরো কতক মনীষী ইবনে মাজার পূর্ণ ও আংশিক ভাষ্য রচনা করেন। তিনি একখানা তাফসীর গ্রন্থও রচনা করেন বলে উল্লেখ আছে, কিন্তু অদ্যাবধি এর কোন পাণ্ডুলিপি কোথাও পাওয়া যায়নি।
সুনান ইবনে মাজায় মাত্র তিনজন রাবী বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা পাঁচ, অর্থাৎ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও ইবনে মাজার মাঝখানে মাত্র তিনজন রাবী, সুনান আবু দাউদে এইরূপ হাদীসের সংখ্যা তিন এবং তিরমিযীতে এক। সহীহ মুসলিম ও নাসাঈতে এরূপ রিওয়ায়াত নাই। সুনান ইবনে মাজার ঐ রিওয়ায়াত পাঁচটি অত্যন্ত দুর্বল। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে কিতাবখানি থেকে ফায়দা অর্জনের তৌফিক দান করুন। আমীন!
বিনীত
অনুবাদক
سنن ابن ماجه